ঋষি রাজনারায়ণ বসু স্মৃতি পাঠাগার : ইতিহাসের এক জীবন্ত অধ্যায়

 



ঋষি রাজনারায়ণ বসু স্মৃতি পাঠাগার : ইতিহাসের এক জীবন্ত অধ্যায়


শুরুর প্রথম পর্যায় এই গ্রন্থাগারের কোনও নির্দিষ্ট নাম ছিল না—চলত কেবল “পাবলিক লাইব্রেরি” নামে। যদিও মেকলের রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৮৩৪ সালে, কিন্তু বাস্তবে এই গ্রন্থাগার গঠিত হয় প্রায় দুই দশক পরে, ১৮৫১ সালে। প্রথম সভাপতি নিযুক্ত হন মেদিনীপুরের তৎকালীন কালেক্টর হেনরি বেলি। তিনি স্থানীয় জমিদার, শিক্ষানুরাগী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহযোগিতায় গ্রন্থাগারের ভবননির্মাণ ও পুস্তকসংগ্রহের জন্য প্রায় ২৪০০ টাকা অনুদান সংগ্রহ করেন। বঙ্গসমাজে শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে ১৮৩৪ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক তৎকালীন একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন টমাস বেবিংটন মেকলে। মেকলে তাঁর প্রতিবেদনে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন, গ্রামীণ প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার এবং শহরাঞ্চলে সাধারণ গ্রন্থাগার গড়ে তোলার সুপারিশ করেন। তাঁর প্রস্তাব অনুসারেই বাংলায় ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৫৫টি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই ৫৫টির মধ্যে আজও টিকে থাকা বিরল প্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম হলো মেদিনীপুর শহরের ঋষি রাজনারায়ণ বসু স্মৃতি পাঠাগার।

         গ্রন্থাগারের বর্তমান জমিটি একসময় কর্ণগড়ের রানি শিরোমণির—চুয়াড় বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী সেই কিংবদন্তি রাণীর—সম্পত্তি ছিল। পরে জমিটি কয়েকবার হাতবদল হয়ে ১৮৫১ সালে পাঠাগারের জন্য দান করা।


       বেলির উৎসাহে পাঠাগারের কার্যক্রম শুরু হলেও, এর প্রকৃত বিকাশ ঘটে ঋষি রাজনারায়ণ বসুর হাতে। ১৮৫১ সালে তিনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে মেদিনীপুরে আসেন এবং দুই বছর পর, ১৮৫৩ সালে, স্থানীয় মানুষের অনুরোধে এই গ্রন্থাগারের সম্পাদকপদ গ্রহণ করেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, নৈতিকতা ও দেশপ্রেমের প্রসারে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বেলি সাহেবের মৃত্যুর পর প্রায় একক প্রচেষ্টাতেই রাজনারায়ণ বসু এই পাঠাগারকে তৎকালীন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাগারে পরিণত করেন।


১৮৮৫ সালের রেকর্ড অনুযায়ী গ্রন্থাগারের সদস্য ছিলেন ৪৮ জন, যার মধ্যে চারজন ইউরোপীয় ও বাকিরা ভারতীয়। মাসিক চাঁদা আদায় হতো ৩৯ টাকা, আর ব্যয় ছিল প্রায় ২১ টাকা। রাজনারায়ণ বসুর মৃত্যু ঘটে ১৮৯৯ সালে। এরপর পাঠাগারটি হয়ে ওঠে শুধু সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র নয়, বরং গোপনে স্বদেশি আন্দোলনের আশ্রয়স্থল।


এখানেই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মেদিনীপুরবাসী বিদেশি দ্রব্য বর্জনের অঙ্গীকার করেন। বিপ্লবীদের যোগাযোগ বিন্দু হিসেবে গ্রন্থাগারের গুরুত্ব তখন ছিল অপরিসীম—বইয়ের ভিতরে লুকিয়ে থাকত গোপন চিঠিপত্র, এমনকি অস্ত্রও। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ প্রশাসনের সন্দেহের চোখে পড়ে এই প্রতিষ্ঠান; একাধিকবার পুলিশি তল্লাশিতে বহু মূল্যবান দলিল ও বই নষ্ট হয়ে যায়।

     এই পাঠাগারে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির আগমন ঘটেছে—ঋষি অরবিন্দ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভগিনী নিবেদিতা, বিপিনচন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অ্যানি বেসান্ত, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত (বাঘাযতীন) প্রমুখ। ১৯৩১ সালে জেলা শাসক পেডি হত্যাকাণ্ডের পর বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্ত এখানে আশ্রয় নেন। ১৯৩৮ সালে পাঠাগারের নামকরণ হয় “বেলি হল পাবলিক লাইব্রেরি”, আর ১৯৫৩ সালে মেদিনীপুরবাসী একে নতুন নাম দেন “ঋষি রাজনারায়ণ বসু স্মৃতি পাঠাগার”।


      গ্রন্থাগারের সভাপতি, সম্পাদক ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন ঐতিহাসিক দুর্গাচরণ বসু, অভয়চরণ বসু, রায়সাহেব ক্ষীতীশচন্দ্র দত্ত, রাজা রাধাকান্ত দেব (শোভাবাজার), ও মহিষাদলের রাজা দেবপ্রসাদ গর্গ প্রমুখ। ১৯৭৯ সালে এটি সরকারি স্বীকৃতি পায়। দীর্ঘদিন প্রশাসকের অধীনে চলার পর ২০২১ সালে রাজ্যের বর্তমান সরকারনিযুক্ত কমিটি এর দায়িত্ব গ্রহণ করে। বর্তমানে গ্রন্থাগারে প্রায় ২০,০০০টি বই ও ৩,০০০ সদস্য রয়েছে। নেওয়া হয় ২১টি মাসিক ও পাক্ষিক পত্রিকা এবং ১০টি বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি দৈনিক সংবাদপত্র। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার উপযোগী একটি ক্যারিয়ার গাইডেন্স সেন্টার গঠনের পরিকল্পনাও চলছে। গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে প্রায় ২৩টি দুষ্প্রাপ্য পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি, যেমন—


★মহাভারত (কাশীরাম দাস, ১২৪৯)

★মহিম স্তব

★শব্দকল্পদ্রুম (কৃষ্ণ নাগেন রচিত, ১৭৬০)

★The Old Testament, Vol. 1 (1820)

★সুরাতুল খেয়াল (সৈয়দ আলি মহম্মদ, ১৮৮১)



গ্রন্থাগারের সঙ্গে যুক্ত একটি প্রাচীন পুকুর রয়েছে, আয়তন প্রায় ১.৫৭৫০ একর। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’-তে যার উল্লেখ পাওয়া যায়। বলা আছে-- "মেদিনীপুর শহরে এক মুঘল দুর্গ ছিল—এই পুকুরটি সেই দুর্গবাসীরা ব্যবহার করত, তাই এর নাম হয় ‘কেল্লা পুকুর’। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই পুকুরটি পাঠাগারকে দান করা হয়, কারণ বলা হয়, ইংরেজ পুলিশ জলকে ভয় পেত; বিপ্লবীরা তাই এই পুকুরে আত্মগোপন করে বহুবার গ্রেফতারি এড়াতেন।"

           আজও রাজনারায়ণ বসু স্মৃতি পাঠাগার শুধু একটি পাঠাগার নয়—এটি ইতিহাস, দেশপ্রেম ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল হয়ে নির্বাক ভাবে দাঁড়িয়ে ইতিহাস গুছিয়ে নেয় রোজ।

                           ★★★★★★


Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.