শিলদা রাজবংশের ইতিহাস
ও অড়গঁদার ভৈরবথান
বীণপুর থানার অন্তর্গত শিলদা গ্রামের প্রায় এক ক্রোশ উত্তরে আজও দেখা যায় প্রাচীন রাজবংশের গড়বাড়ি ও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। কাছেই ভৈরব-ডাঙ্গা নামের এক স্থানে ভৈরবদেবের প্রাচীন আসন রয়েছে। ভগ্ন প্রস্তরমঞ্চের উপর স্থাপিত সেই ভৈরবমূর্তি দেখে বোঝা যায়—একসময় সেখানে সম্ভবত একটি বৌদ্ধবিহার ছিল, যা পরে রূপান্তরিত হয়েছে শৈব ধর্মের উপাসনালয়ে। জনশ্রুতি অনুসারে, শিলদার রাজবংশ শৈব ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাই ঐ অঞ্চলের নানাস্থানে শিবলিঙ্গ ও প্রস্তরময় ষণ্ডমূর্তি ছড়িয়ে আছে। ওড়গোঁদা গ্রামের রাজবাটীর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে একটি বৃহৎ প্রস্তরমূর্তি ষণ্ড এখনও এত সুন্দরভাবে টিকে আছে যে, দূর থেকে দেখলে জীবন্ত ষাঁড় মনে হয়। পরবর্তীকালে নতুন এক রাজবংশ শিলদায় অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং সেখানেই তাঁদের রাজধানী স্থাপন করে। তাঁদেরই কীর্তি হিসেবে এখনো বিখ্যাত “শিলদার বাঁধ” জলাশয়টি রয়েছে।
১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মার্চ তারিখে তৎকালীন শিলদার জমিদার রাজা মানগোবিন্দ মল্ল রায় মেদিনীপুর জেলার কালেক্টর সাহেবের নিকট এক চিঠি লেখেন, যেখানে তিনি তাঁদের রাজবংশের ইতিহাস বর্ণনা করেন। সেই বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বঙ্গাব্দ ৯৩১ (খ্রিষ্টাব্দ ১৫২৪) সালে তাঁর প্রপিতামহ রাজা মেদিনীমল্ল রায় দক্ষিণ দেশ থেকে সসৈন্যে এসে তৎকালীন ঝাঁটিবনী বা শিলদা প্রদেশের রাজা বিজয় সিংহকে পরাজিত করে এই অঞ্চলে নিজেদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বিজয় সিংহের বংশ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু জানা যায় না, তবে জনশ্রুতি বলে—এর আগেও এ অঞ্চলে ডোম জাতির এক রাজবংশ রাজত্ব করত। বর্তমানে “ডোমগড়” নামে যে মৃত্তিকাস্তুপ দেখা যায়, সেটিই নাকি সেই ডোম রাজাদের পুরনো গড়। ধারণা করা হয়, বিজয় সিংহের পূর্বপুরুষই ডোম রাজবংশের শেষ রাজাকে পরাস্ত করে রাজ্য দখল করেছিলেন। তাঁদের রাজধানী ছিল শিলদার এক ক্রোশ উত্তরে অড়গোঁদা গ্রামে।
রাজাদের উত্তরাধিকার
মেদিনীমল্ল রায় প্রায় ৪১ বছর রাজত্ব করে মৃত্যুবরণ করেন।
তারপর ধারাবাহিকভাবে রাজত্ব করেন—
তাঁর পুত্র মঙ্গলরাজ রায় (৫৭ বছর),
এবং পৌত্র গৌরহরি রায় (৬৭ বছর)।
গৌরহরি রায়ের তিন পুত্র ছিলেন—বলরাম, হরিশচন্দ্র ও মানগোবিন্দ।
বলরাম ও হরিশচন্দ্র উভয়েই রাজা হয়েছিলেন, কিন্তু নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তৃতীয় ভাই মানগোবিন্দ মল্ল রায় জমিদারীর অধিকার পান। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দশসালা বন্দোবস্তের সময় মানগোবিন্দই ছিলেন শিলদার জমিদার। ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
জমিদারীর উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদ
মানগোবিন্দ মল্ল রায়ের সাতজন রাণী ছিলেন। মৃত্যুর পর রাণী কিশোরমণি সম্পত্তির অধিকারিণী হন। তিনি তাঁর দেওয়ানের পুত্র শ্রীনাথচন্দ্র পাত্রকে দত্তক পুত্র রূপে গ্রহণ করেন। ১৮৪৮ সালে রাণী কিশোরমণির মৃত্যুর পর জমিদারীর উত্তরাধিকার নিয়ে মামলা ওঠে—
একদিকে ছিলেন শ্রীনাথ পাত্র, অন্যদিকে মানগোবিন্দের জ্ঞাতি জগন্নাথ মল্ল। মামলায় শ্রীনাথ জয়লাভ করেন। কিন্তু কিছুদিন পরে মানগোবিন্দের অন্য রাণীর গর্ভজাত কন্যার পুত্র, অর্থাৎ রসপাল গড়ের জমিদার মুকুন্দনারায়ণ দেও, দৌহিত্র সূত্রে জমিদারীর দাবি করে মামলা করেন। ১৮৫৭ সালে মামলায় মুকুন্দনারায়ণ দেও জয়লাভ করে শিলদার অধিকার পান, আর শ্রীনাথ পাত্র রাজাচ্যুত হন।
তবে মুকুন্দনারায়ণ বেশিদিন জমিদারী ভোগ করতে পারেননি—অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে তাঁর জীবদ্দশাতেই জমিদারীর বড় অংশ ঋণের দায়ে হস্তান্তরিত হয়। অবশিষ্ট অংশও তাঁর পুত্র সুন্দরনারায়ণ দেও-এর সময়ে হারিয়ে যায়।পরবর্তীকালে মেদিনীপুর শহরের কর্ণেলগোল্লা পল্লীর জমিদার গঙ্গারাম দত্তের পিতা ভোলানাথ দত্ত কিছুদিন শিলদার জমিদার ছিলেন। তাঁদেরও অর্থাভাব দেখা দিলে জমিদারী মেদিনীপুর জমিদারী কোম্পানির হাতে চলে যায়।
এখনও সুন্দরনারায়ণের বংশধরগণ রসপাল গড়ে ও তাঁর ভাই যজ্ঞেশ্বর নারায়ণের পুত্রগণ শিলদায় বসবাস করছেন।
শিলদা-ঝাঁটিবনির রাধাগোবিন্দ মন্দির
শিলদা ঝাঁটিবনিতে এক প্রাচীন রাধাগোবিন্দ মন্দিরের প্রস্তরলিপিতে লেখা আছে:
১. পক্ষ্যবেদসমুদ্রশ্চ শশি-
২. সঙ্খ্যা সকাব্দসু। কেশবঃ
৩. প্রিতকার্য্যে সুদার্ষদা চ দদা-
৪. ম্যহং।। সকাব্দা ১৭৪২। ১১।।
এর অর্থ হলো—
“পক্ষ (২), বেদ (৪), সমুদ্র (৭) ও শশি (১)—এই সংখ্যা অনুযায়ী শকাব্দ ১৭৪২ সালের ১১তম মাসে কৃষ্ণের প্রীতির জন্য আমি এই সুন্দর প্রস্তরনির্মিত মন্দির দান করলাম।”
শকাব্দ বা শালীবাহনাব্দ কী
শকাব্দ (অথবা শালীবাহনাব্দ) ভারতের এক প্রাচীন সৌর অব্দ, যা বঙ্গাব্দের প্রায় ৫১৫ বছর পূর্বে এবং খ্রিষ্টাব্দের ৭৮ বছর পরে চালু হয়। এই অব্দের সূচনা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতভেদ থাকলেও সাধারণভাবে মনে করা হয়—রাজা শালীবাহন যখন বিদেশি শক জাতিকে পরাজিত করে “শকারি” উপাধি নেন, তখন থেকেই এই অব্দের প্রচলন শুরু হয়।
শকাব্দ একটি সৌর অব্দ, যেখানে দিন ও মাস গণনা করা হয় সূর্যসংক্রান্তি অনুযায়ী, প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানের গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’-এর নিয়ম মেনে।
রংকিনী ও ভৈরবঃ সাতভূমের গোপন অলৌকিক কাহিনী
(লোকবিশ্বাস, ইতিহাস ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন)
বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে যে বিস্তীর্ণ জনপদকে একসময় “সাতভূম” বলা হত—মল্লভূম, শিখরভূম, ধলভূম, মানভূম, সিংভূম, বরাভূম ও সাঁতভূম—সেই সাতটি ভূমির প্রতিটি মাটিতেই জড়িয়ে আছে রংকিনীর কিংবদন্তি। সেই রংকিনী—ধলভূমের কুলদেবী, যাঁর অলৌকিক উপস্থিতি এখনও ঘাটশিলার পাহাড়, নদী,জঙ্গল ও কুয়াশার মাঝে অনুভব করা যায়।
লোকশ্রুতি আছে, ধলভূমের রাজা রাজপুতানা থেকে দেবী রংকিনীকে এনে প্রথমে মহুলিয়ায় এবং পরে ঘাটশিলায় প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তার আগে থেকেই নাকি দেবী ছিলেন মানভূমের পঞ্চকোট দুর্গে। পঞ্চকোট রাজার সঙ্গে তাঁর এক ভয়ঙ্কর শর্ত ছিল—প্রতিদিন তাঁকে ‘ভোগ’ হিসাবে একটি মানুষ দিতে হবে। প্রতিদিন মানুষ বলি দেওয়া হত, আর দেবী সেই মানুষকে ঢেঁকিতে কুটে খেয়ে ফেলতেন!
একদিন সেই বলির পালা এল এক চাষির একমাত্র ছেলের। চাষি ভয়ে ও দুঃখে কেঁদে আকুল। তখন তার গোরু--বাছুর চরানো বাগালটি বলল,
“চিন্তা কোরো না মালিক, তোমার ছেলের বদলে আমি দেবীর কাছে যাব।”
বাগাল রওনা দিল রংকিনীর উদ্দেশ্য। তার কোঁচড়ের একদিকে লোহার ছোলা, আরেকদিকে সত্যিকারের ভাজাছোলা। রংকিনীর স্থানে পৌঁছাতে একটু দেরি হল, আর সেই দেরিতেই রেগে আগুন রংকিনী,ক্রুদ্ধ রক্তবর্ণা দন্ত সজ্জিত বিবর উন্মুক্ত করে তাকে গ্রাস করতে এলে বাগাল শান্ত গলায় বলল--
“রাগছ কেন মা? আগে দুটো ছোলাভাজা খাও, তারপর খেও আমাকে।”
সে লোহার ছোলা এগিয়ে দিল দেবীর দিকে, আর নিজে মহানন্দে আসল ছোলা চিবোতে লাগল কড়মড় শব্দে। রংকিনী লোহার ছোলা মুখে দিতেই যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। তখন বাগাল হেসে বলল--
“দাঁত দিয়ে ছোলা খেতে পারো না, আর তুমি কিনা মানুষ চিবাবে?” ভয়ে, লজ্জায়, অপমানে রংকিনী তখন পালিয়ে বাঁচতে চাইল। বাগাল তার দুই কুকুরকে লেলিয়ে দ্যায়-- “লেহ ছু..! লে ধর ধর!”—আর নিজে হাতে নিল দেবীর ঢেঁকি। ভয়ঙ্কর ধাওয়া শুরু হল। নদী, নালা, ডুংরি, পাহাড়, জঙ্গল, মাঠ পেরোতে পেরোতে রংকিনী দৌড়াতে লাগল। দৌড় দৌড় সে এ অনন্ত দৌড় য্যানো। অবশেষে এক নদীর ধারে কাপড় কাচতে থাকা ধোপার কাছে গিয়ে বলল--
“আমাকে বাঁচাও বাবা, ওই বাগাল আর কুকুরদুটি থেকে আমাকে রক্ষা কর !”
গত্যন্তর না পেয়ে ধোপা তাকে নিজের কাপড় কাচার পাটির(শিলাখণ্ডের) নিচে লুকিয়ে রাখল। কিছুক্ষণের মধ্যে বাগাল ও তার কুকুরেরা সেখানে এসে হাজির হল এবং জিজ্ঞেস করল-- “রংকিনীকে এখানে তিনি দেখেছ না কী?”
ধোপা ভয়ে শিস দিয়ে পাটির তলার দিকটি ইশারায় দেখিয়ে দিতে লাগল। বাগাল কিছু বুঝতে না পেরে ফিরে গেল। তখনের মত রংকিনী বেঁচে যাওয়ার আনন্দে ধোপাকে বলল-- “তুই আমাকে বাঁচিয়েছিস, তাই তোকে ধলভূম রাজ্যের রাজা করে দিলাম। কিন্তু তুই আমাকে ধরিয়ে দিতেও চেয়েছিলি—তাই অভিশাপ দিলাম, কাপড় কাচার সময় শিস না দিলে তোদের অর্থাৎ সমগ্র ধোপাকূলের সার্বিক ক্ষতি হবে।” সেই থেকেই ধলভূমে দেবী রংকিনীর অবস্থান।
পুরখাবুঢ়ারা বলেন--'মানে রা শিখরে পা, সাক্ষাৎ দেখবি ত ধলভূমে যা।'
অর্থাৎ মানভুমে আওয়াজ শোনা যেত। পায়ের ছাপ পড়ত শিখরভূমে। আর রংকিনীকে চোখের দেখা দেখা যেত ধলভূমে।
মানভূমে এখনও আছে সেই “বাগালিয়াবন”—যেখানে দুর্জয় বাগালের আত্মা ঘোরে। প্রতি বছর জিতুআ অষ্টমী থেকে মহানবমী পর্যন্ত ধলভূমগড়ের ঘাটশিলায় যে ‘বিঁধা পরব’ হয়, সেটি শেষ হয় ওড়গোদার ‘পাতাবিধা’ পরবে। একসময় এই বিঁধা পরবে রাজা ও রাজপুরোহিত একসাথে দুইটি ‘কাড়া’ মোষকে তির ছুঁড়ে বিঁধতেন। তির বিঁধা পড়লেই সেই মোষদের বলি দেওয়া হত রংকিনীর থানে। এখন সে প্রথা বিলুপ্ত—কাড়া মোষের বদলে এখন বলি দেওয়া হয় ছাগল, হাঁস, মুরগি, কুমড়ো, লাউ...।
বাবা ভৈরব ও অড়গোঁদার অলৌকিক লোকবিশ্বাসঃ-
অড়গোঁদার ভৈরব থানে এখনো সেই পোড়ামাটির প্রাচীন বিগ্রহ স্থির দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে ভগ্ন মন্দিরের নিদর্শন—চতুষ্কোণ পাথরের ছাঁচ, ষাঁড়ের পাষাণমূর্তি, ছিন্ন মোরগের গলা, গরুর গাড়ির চাকা, বর্গা পুখরি ও পুরনো রাস্তার ধারে দেবমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। কথিত আছে, এক সময় ভৈরব মূর্তির মুখে সোনার দাঁত ছিল—যা পরবর্তীতে ইংরেজরা লুঠ করে নিয়ে যায়।
লোকবিশ্বাসে বলা হয়—বাবা ভৈরব আসলে সাতভূমের অভিভাবক। তিনি এই আগ্নেয়, রুক্ষ মাটিকে বেছে নিয়েছিলেন নিজের আসন হিসেবে। এক রাতে তিনি নিজের হাতে মন্দির গড়তে চেয়েছিলেন। দূর থেকে গরুর গাড়িতে পাথর আনতে আনতে ভোরের মোরগ ডেকে ওঠে—আর সঙ্গে সঙ্গেই নির্মাণ থেমে যায়। সেই অসম্পূর্ণ মন্দিরের ভগ্ন পাথরগুলো আজও পড়ে আছে নিদর্শন হিসেবে।
ভূতত্ত্ববিদেরা অবশ্য অন্য ব্যাখ্যা দেন। তাঁদের মতে, ভৈরব থান একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরির উপর অবস্থিত। ভৈরব মূর্তির নীচেই রয়েছে প্রাচীন জ্বালামুখ, যেখান থেকে মাঝেমধ্যে গরম বাতাস বেরোয়। তাই মাটি কেঁপে ওঠে, ‘গুড়গুড়’ শব্দ হয়, মূর্তির গায়ে জলবিন্দু জমে—যা মানুষ ভৈরবের ঘাম বলে মনে করে।
ভৈরব থান ও পাতাবেঁদা পরব
মানুষের বিশ্বাস অড়গোঁদার ভৈরব থানে বেলে পাথরের প্রাচীন পূর্ণাবয়ব ভৈরবমূর্তি সদর্পে বিরাজ করছেন আজও। (যদিও মূর্তিটি বছর তিনেক আগে চুরি হয়ে যায়।) পাশে অর্ধনির্মিত মাকড়া পাথরের মন্দির, বেদীতে আটটি স্তম্ভের চিহ্ন আজও বহন করে চলেছে—এই সবই অতীতের সাক্ষী। লোকমতে, এই ভৈরবেরই ভৈরবী হলেন রংকিনী। ধলভূমগড়ের জিতুআ পরবের দিনে যখন রংকিনীর থানে "বেঁদ পরব" হয়, তখন ভৈরব যান সেখানে। আর বিজয়া দশমীর দিন ভৈরব থানে যখন পাতাবেঁদা(বা পাটাবিঁধা) পরব হয়, তখন রংকিনী আসেন এখানে।
প্রাচীন গণনা-পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত একটি কুড়মালি প্রবাদে বলা হয়—
“বারই বিঁধা, সউলই পারবণ, আর কুড়ি এ বাঁদনা।”
অর্থাৎ, করম পরবের বারো দিন পরে জিতুআ/বিঁধা পরব, তার ষোলো দিন পর পারবণ, এবং সেই পারবণের কুড়ি দিন পর বাঁদনা পরব পালিত হয়।
পারবণ—এই দিনটি বসমতা মায়ের সাধভক্ষণ অনুষ্ঠানের দিন।
রহইন পরবে যে ধানের বীজ চারা দেওয়া হয়েছিল, আজ সেই ধানগাছ পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে য্যানো অন্তঃস্বত্তা নারীর মতো জীবনদায়ী হয়ে ওঠে।
এই উপলক্ষ্যে প্রাচীনকাল থেকেই কৃষিজীবী সমাজে এই বিশেষ আচারের প্রথা প্রচলিত—আতপ চালের গুঁড়ো, ঘি, মধু ও গুড় মিশিয়ে দেবী বসমাতার সাধভক্ষণ করানো হয়।
এ প্রথার সূচনা কৃষি সভ্যতার আদিযুগের, যখন মানুষ প্রকৃতি ও জীবনের প্রজনন শক্তিকে একত্রে পূজা করত—ধানগাছের বৃদ্ধি, পৃথিবীর উর্বরতা, এবং মাতৃত্বের পবিত্র রূপ এই উৎসবে একাকার হয়ে যায়। এই প্রবাদের সাথের এই পাতাবিঁধা/পাটাবেঁদার কতটা সম্পর্ক তা অন্যান্য গবেষকগণ আরও নিখুঁত ভাবে ও যুক্তি সঙ্গত উপায়ে বলতে পারবেন।
তবে লোকবিশ্বাস এই দুই তীর্থক্ষেত্র—ভৈরব থান ও ধলভূমগড়—এর মধ্যে একটি গুপ্ত সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে। সেই পথ দিয়েই ভৈরব-ভৈরবীর যাতায়াত। তাঁদের মিলনের সময় শিলদার মাটি কেঁপে ওঠে, আর ‘গুড়গুড়’ শব্দে প্রতিধ্বনিত হয় সমগ্র সাতভূম। পাতাবেঁদা উৎসবে ভৈরব-রংকিনীর মিলিত শক্তির প্রকাশ ঘটে। হাজার হাজার আদিবাসী পুরুষ ও নারী জড়ো হন এখানে। তারা তীর-ধনুক হাতে যুদ্ধনৃত্য ভুয়াং নাচ করে, সিংহের মতো গর্জে ওঠে, গানের তালে তালে বাজে ঢোল-মাদল। সারা ভারতবর্ষ থেকে নানা জনজাতির মানুষ আসে এই মিলনমেলায়—কারও মানত পূর্ণ করতে, কেউ বা নিছক ভক্তিতে। মানুষের বিশ্বাস, বাবা ভৈরব ও রংকিনীর মিলনে প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরে আসে, মাটি উর্বর হয়, গ্রামে শান্তি নামে।
তাই আজও সাতভূমের মানুষ গান গায়—
“আরাঃ হাসা হর এগো,
রূপমা ঞংগর ঞংগর,
অকয় বুজা গাহির অন্তর?
উনিমা এটাঃ হড়।”
(কবি সারিধরম হাসদা মহাশয়ে লেখা থেকে সংগৃহীত)
অর্থাৎ—“রাঙা মাটির সহজ কথা, কেউ বোঝে না মনের ব্যথা।”
আজও সূর্যাস্তের পর যখন ভৈরবটাঁইড়্যে বহড়া-হরিতকী গাছের ডালে টুনি-বাল্ব জ্বলে ওঠে, তখন মনে হয় সেই দেবযুগের কাহিনী আবার ফিরে এসেছে। রংকিনীর রহস্যময় দৃষ্টি যেন পাহাড়ের ওপার থেকে আজও তাকিয়ে থাকে ধলভূমের দিকে, আর ভৈরবের অর্ধনির্মিত মন্দির থেকে শোনা যায় নীরব গুঞ্জন—
“আমি আসছি রংকিনী… মাটির গহ্বর ফুঁড়ে আবার তোমার কাছে।”
শিলদা রাজবংশের ইতিহাস শুধু এক রাজপরিবারের কাহিনি নয়—এটি দক্ষিণবঙ্গের মধ্যযুগীয় সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। আজ গড়বাড়ি ও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে সময়ের ছাপ পড়েছে বটে, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় শিলদা ও মল্ল রাজাদের ঐতিহ্যে এখনও অম্লান।
★★★★★★
https://youtu.be/r27fNApEC2s লিংকটি ক্লিক করে দেখতে পারেন।
ঋণ
L.S.S O'MALLEY, H.H RISHLE, প্রণব রায়, তারাপদ সাঁতরা, যোগেশচন্দ্র বসু, সারিধরম হাঁসদা, মনোরঞ্জন মাহাত ও অন্যান্য গ্রামবাসী / পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীদের থেকে সংগৃহীত...



