আহাম্মকের গদ্য
"রিসাইকল বিন"
সব পি.সি, সব সফটওয়্যার বোধহয় সবকিছু সাপোর্ট করে না, যদি করতো কী অদ্ভুত ভাবে ভালো হত সব, ডিলিট যাওয়া ফাইলগুলো তুলে আনা যেত এখন। যদি এই ‘চলতি কা নাম গাড়ি’তে সেই সব রঙিন পালক ছেনে আনা যেত সেই মুহূর্ত চাদর! তবে এ কোথায় ক্লিক করেছি যে উঠে এলো সারি সারি মৌন হীরক...
ফুলডুংরির ওপাশে আমাদের একটি সাঁকো ছিল; নিতান্ত নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোখান - আমাদের খুব আপন। আমরা মানে-আমরা যারা ইস্কুল পড়ুয়া, অথব না পড়ুয়া (যদিও এদের সংখ্যাই বেশী)। ডুলুং-এর নীচু হয়ে আসা চর ঘেঁসে আড়াআড়ি বাঁধা। নদীটির ওপাশে হলুদবনী, ফুলপাহাড়ী, শালপাতড়া, জড়সা আরও না জানি কী কী গাঁ। আমরা বিকেলে তার নীচে বালির চরে লুটোপুটি দিতাম। আর যখন থৈ থৈ বর্ষা আসত মাথায় কচু পাতা বেঁধে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতাম। মাছ যে খুব পড়ত তা নয়, তবু ঐ ছিল আমাদের সুখ বাক্স। শুধু আমি আমার রুগ্নতা নিয়ে সেই সাঁকোর মোটা খুঁটিটাতে হেলান দিয়ে ভাবতাম- এ সাঁকো বড় আদরের, এ সাঁকো আমার অন্তরের-কীভাবে কয়েকটা খুটি আর বাঁশ জুড়ে দেয় দুটো বিচ্ছিন্ন গ্রাম, মন, শৈশব। অথবা আরও বড় কিছু - আশ্চর্য লাগত আমার অথচ আমাদের এপিঠ ওপিঠে থাকা জঙ্গল নিয়ে আমাদের উৎসাহ ছিল না তেমন কোনদিই। ও ছিল আমাদের দাদা কাকা, বাবা মা, কাকিদের - এরা সকলেই ভোর বেরিয়ে যেত কাঠ-পাতের খোঁজে, মেয়েরা পাতা-ই তুলত বেশি। আমাদের বাচ্চাপার্টির জিম্মায় শুধু ওই সাঁকোটুকু। তবে ও পাওনাও কম কিছু ছিল না। আর জঙ্গল! ও ছিল আমাদের সান্ধ্য গপ্পোকথা। কীভাবে শেয়ালেরা গর্তে শরীর মুড়ে রাখে, খরগোসের দ্রুততা, ভামের তীব্র নজর আর পাহাড়ি টিয়া টেঁসা কেরকেটাদের অজানা কিসসা। শুনতে শুনতে মনে হত এলডোরাডোর গোপন রহস্যের কথা-আলিবাবার খুঁজে পাওয়া সেই চল্লিশ চোরের গোপন গুহার কথা - সব মিলেমিশে এক হয়ে যেত। তবে সব কিছু ছাপিয়ে গেছল রঁঝাখুড়োর সাপ আর নেলের যুদ্ধের কিস্সা। সারা গায়ে যেন কিলবিলে পোকা জেগে যেত। সে নাকি ঝোপের আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখেছে সেসব - কীভাবে নেল খেলিয়ে খেলিয়ে মেঠো খরিশকে কেটে টুকরো টুকরো করে তাতে জিয়ন কাঠি বুলিয়ে আবার বাঁচিয়ে দিয়েছিল। সেই কাঠিও নাকি সে পেয়েছে। তবে দেখাত না কাউকে।
তখন ভরপুর বর্ষা। তিনদিন সূয্যির দেখা নেই। অরু বামুনের গাইড়্যাটাও ভেসে গেছে, চারদিক থৈ থৈ জলে জল। পাড়ার কেউ এসে খবর দিল ডুলুং খেপেছে, নাগদি বিরামডিহি জুড়ুম সব ভেসে গেছে। জল উঠে এসেছে 'বালি' অবধি ।
আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। আমরা তখন পাটা, ঘুনি, ছাঁকি জাল পেতে মাছ ধরায় মশগুল। কত ধরনের মাছ দানাহুলি, ট্যাংরা, গেঁতি,ডাঁইক্যা চিড়াকুটি...।
মাইক্রোসফ্ট, পেন্টিয়াম টু এর আগের ভার্সন পি.সি.টা, তবে মাইক্রোসফ্ট অফিসটা সুন্দর সাপোর্ট করে। লগ-ইন হতেও সময় কম লাগছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠল নীল কালো লাল বোতামের মতো আইকনগুলো। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো তিতলির মতো তিরটি বিঁধিয়ে দিলাম একটিতে। মুহূর্তে ঘিরে ধরল দৃষ্টি।
ঠিক সন্ধ্যে তখনও হয়নি, দলে দলে মাথায় পোঁটলা কাঁখে বাচ্চাদের নিয়ে সারি সারি লোক এসে ভিড় করেছিল আমাদের ইস্কুল বাড়িতে। বৃষ্টি তখনও থামেনি। গ্রামে যাদের বাড়িতে দুই-র বেশী হ্যারিকেন লণ্ঠন ছিল সেগুলো এনে জ্বালিয়ে দিয়ে গ্যাছে পাড়ার বড়রা। সকলেই কিছু কিছু চালডাল সাধ্য মতো সবজি দিয়ে খিচুড়ি চাপানো হল। সেদিন খুব মজা হয়েছিল আমাদের। আমরা বুঝিইনি কার কী ভেসে গ্যালো, আমরাই বা কী হারালাম। শুধু মনে হয়েছিল এভাবেই যদি সব্বাই একসাথে থাকা যায়, বড় ভালো হয়। লুলু, আমি, রহিম, চুপুল, পবন সব্বাই...
একটা থেকে একটা ফাইল খুলে যাচ্ছে অবলীলায়, আর অটোম্যাটিক বদলে যাচ্ছে ব্যাকগ্রাউন্ড ভিউ। হার্ডডিস্কের ক্যাপাসিটি যে এ্যাতো, ভাবিইনি কখনও। এক একটা র্যামকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে ফেলছে আমার হার্ডডিস্ক।
প্রথম খবরটা এনেছিল সালকু। সে-ই রোদ উঠতে গরু নিয়ে গেছল ডুংরির দিকে। আমরা তখন বটতলায় লাট্টু খেলছি। মগলার ম্যাজিকের মতো লেত্তি থেকে ছেড়ে দিয়ে মাটিতে না ফেলে বনবন ঘুরন্ত লাট্টু হাতের চেটোতে ঘোরাচ্ছিল। সালকু ছুটতে ছুটতে এল। খুব হাঁপাচ্ছিল জিরজিরে আদুর বুকের ভেতর দিয়ে যেন ফুসফুস ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমরা ওর দিকে ফিরে তাকাতেই ও বলল- নেই-! সবাই খেলা ফেলে ছুট ছুট …! উঁচু ঢিবিটা পেরিয়ে সবাই থমকে দাঁড়িয়ে দেখলাম সত্যি নেই। কিছু দূরে পড়ে আছে বাঁশের ছেঁড়া ছেঁড়া শরীর আর সেই মোটা খুঁটিটা। যাতে শুধু আমি হেলান দিয়ে ভাবতাম- কীভাবে এই সাঁকো জুড়ে দেয় দুটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম বা তারচেয়েও বেশী কিছু। ডুলুংএর বুকে খো খো জল ছুটছে তখন।
ওপাশের গ্রামগুলো আলাদা হয়ে গ্যালো তারপর। যারা কারণে অকারণে বটতলায় এসে ক্ষণিক জিরোতো তাদের আর সে ভাবে দেখা পাইনি। হরমুজ মিঞা, কাসেম কাকারা কীভাবে যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। বাবুরা দফায় দফায় এসে সরেজমিনে তদন্ত করে নাকি বলে গেছল ‘ওটা পাকা পুল হবে’। এক এক করে ডুলুং-এ বহুবর্ষা ছুটে গ্যালো, হরমুজ মিঞা, সাবের, কাসেম কাকাদের স্মৃতিও ধোওয়া হয়ে গ্যালো। সঙ্গে আমাদের শৈশবও। শুধু মাঝে মাঝে ইস্কুল ফেরতা পথে দেখতাম সারি সারি লোক চলেছে -"যোগ দিন-- যোগ দিন-- স্বরে”। ভাবতাম কী যোগ, কেন যোগ! জুরান বলত আন্দোলন- আন্দোলন-
“নিতি পাত তুলি ঝুড়ি ঝাঁটি দাঁতন কাঠি
আজ কেনে বাবুই করে মানা হে
উয়াদের বন নাঞ ছিল জানা।।"
ধীরে ধীরে জঙ্গলের গপ্পো বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল; অথবা সত্যি সেগুলো গপ্পোই হয়ে গেছল। জঙ্গলের কেউ যেতে সাহস করত না তেমন আর। যারা তারপরও উপেক্ষা করে যেত পেটের ডাকে হয় তাদের সাইকেল, কুড়ুল অথবা টাঙি খোয়া যেত। কারা যেন কাড়িয়ে নিত। জুরান বলত, বনবাবু - সরকারের অর্ডার। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে ভাবে, কপালের সামনের দিকের চুল পাতলা হতে হতে ফাঁকা হয়ে যায় সেভাবেই জঙ্গলগুলোও ফাঁকা হতে শুরু করেছিল। বটতলা জমত না আর তেমন। কাউকেই পাওয়া যেত না। সকলেই কেমন ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। হারিয়ে যাচ্ছিল বেশ কিছু মুখ, জুরান বলত, ‘ওরা নামাল খাটতে গেছে'। প্রাণ হারাচ্ছিল সব কিছু থেকে। ছোট্ট গ্রামটাতে গড়ে উঠছিল আরও ছোট ছোট গ্রাম। নদীর লুটোপুটি, জঙ্গলের কিসসা তখন অন্যরকম। যে সব মেয়েরা পাতা তুলতে যেত তারা এসে খুব কাঁদত। কেউ কেউ যন্ত্রের মতো নির্বাক হয়ে যেত। বুঝতাম না ওদের কত দামী - কি-ই বা খোওয়া গেল। চুনু পিসি রাতের আঁধারে গরামথানে ঝুলে আসা মহুল ডালে বাবুই দড়িতে ঝুলে পড়ল একদিন।
"এই তো আমাদের আঁধার জোনাক জলের শরীরে মিশে আছে মাছেদের গতিপথ, পাথরের কোল স্থবির হয়েছে বহুদিন।"
ওটাই প্রথম কিনা মনে নেই ঠিকঠাক, তবে রক্তের ঘনত্ব যে এত নিবিড় সেটুকু স্পষ্ট। বাঁদনার দিন। ঢিলেঢালা ভাবের পরব। হঠাৎ খেয়াল হল মুহূর্তের মধ্যে গ্রামটা কেমন থম মেরে গ্যালো। জড়সড়ো এক হাওয়া। সকলেই চাপা চাপা স্বরে কথা বলছে। আমার একমাত্র উত্তরদাতার কাছে গিয়ে দেখি সে উবু হয়ে বসে জাল বুনছে তখন। আড় চোখে আমায় দেখে জুরান বলল- চুনুর ভাই, থানায় নিয়ে গেছল, ওরা রাতেও ফেরেনি। এখন নাকি ভানসিং মাঠে উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
খুব দ্রুততার সঙ্গে বদলে যাচ্ছিল সব। মাঝে মাঝেই আসতে শুরু করেছে তখন উর্দি পরা জিপ। কারুর কারুর বাখরের হাঁড়ি খুঁজতে গিয়ে নস্যাৎ করে দিয়েছে সব। কতদিন সোজা হয়ে হাঁটতে পারেনি মধু মাহলি। সাদামাটা কোলাজের গা থেকে মুছে গ্যালো সে নামও একদিন। খাঁদু, পঞ্চা, লুলা, লেপা, ঠুঁঙু, ডেগা আরও - আরও অনেকেই যে ভাবে মুছে গিয়েছিল। এদের চলে যাওয়ার প্রমাণ কারও কাছেই নেই। এমনকি আমার কাছেও। তবে মানুষগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার করি কোন প্রামান্যের অভাবে?
" এ আমার কোন মোহ মুখ বাঁশি
দ্যাখো
কীভাবে হোমের আগুন ছিঁড়ে খুঁড়ে খেয়েছে আমায়”
বেশ পুরোণো সব ফাইলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল রঙিন ছেঁড়া ঘুড়ি, কখনও বা লাটিম, লেত্তি অথবা ছায়া ঘিরে ধরা বীথি। কিন্তু হঠাৎই হ্যাং হয়ে গ্যালো সব। রিস্টার্ট করে কন্টিনিউ করলাম। কিছুক্ষণ সব কুল-কাল, কিন্তু হার্ড ডিস্ক স্লো হয়ে আসছিল, প্রবলেমটা বুঝে ওঠা যাচ্ছিল না। আইকন, ফাইল সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।
জুরান বলত ‘আন্দোলন আন্দোলন -'! কিন্তু সেটা কী? কার? কেন? এসব প্রশ্ন ঐ শব্দগুলোকে বয়ে নিয়ে মাথার বিশ বাঁও ওপর দিয়ে যেত। তবে নির্বাক হয়ে গেছলাম সেদিন- যেদিন রেললাইনের ধারে তার অসমাপ্ত জালখানা জড়ানো জুরান আকাশের দিকে স্থির চোখ রেখে চলে গিয়েছিল। একটা মানুষের ভেতর শরীরে এতো রক্ত থাকে দেখে সেদিন অবাক হয়েছিলাম। পীচের মতো কালো চাপ চাপ-
একে একে এবার পুরোনো ফাইলগুলো ডিলিট হয়ে যাচ্ছিল - এ এমনই ভাইরাস, যার কোনো প্রিভেন্ট নেই; কোনো অ্যান্টিভাইরাস ও না। কারণ যে কোম্পানির অ্যান্টিভাইরাস তৈরির কথা ছিল সেই সন্তর্পনে যদি এই সফটওয়্যার ডেভলপ করে ঢুকে পড়ে সমস্ত পি.সি-তে তবে তো পোয়া বারো। বলা বাহুল্য সে অ্যান্টিভাইরাস কোম্পানির কদর কত হবে।
"লোকে বলে হ্যামলিনের বাঁশি
তবু আমার রিংটোন বেজে যায় দ্বিধায় দ্বিধায়।"
আমার ডুলুং, আমার সাঁকো, আমার গ্রাম সব হারিয়ে গেছে তবু নিজেকে উপেক্ষা করতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় চুনু পিসিই ঠিক। যেমন ভাবে শান্তি, আগমনি, শকুন্তলা ফুলমনিরা বুঝে ছিল তাদের শাড়ির কিমত, আমি কিন্তু সেদিন বুঝে উঠিনি এমনই হাঁদারাম।
মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলতে চাইতাম, রঁঝা খুড়া ব, এবার অন্তত বের করে ছুঁইয়ে দাও তোমার লুকিয়ে রাখা জিয়নকাঠি এই মরে যাওয়া গ্রামের শরীরে, এই ক্লিকে ক্লিকে বিঁধে যাওয়া পেন্টিয়াম-টু এর শরীরে।