ভারতীয় ফুটবলঃ ইতিহাস ও মিথ
আজকাল ফুটবল মরশুম। কত ইতিহাসই না ধুলো ঝাড়বে আগামি প্রজন্মের কাছে। যখন ফোর ফাইভে পড়ি তখন থেকে বাবার হাত ধরে ফুটবলের প্রেমে পড়া। না তা বলে এটা ভেবে বসা মোটেও সমীচিন হবে না যে আমি একজন কেউকেটা ফুটবলার... তবে হ্যাঁ একজন
ফুটবল প্রেমিক বললে খুব ভুল হবে না।(যদিও ইদানিং হাতে গোনা কিছু ক্লাব ফুটবল বাদে অধিকাংশই দেখি না)। বাবা একসময় ফরোয়ার্ডে খেলত, দু একবার মুখ ফসকে বলতে শুনেছি। তবে সে সবই সাবডিভিশন পর্যন্তই, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু গাঁয়ের ছা সামান্য টেনকঅ টিমে খেললেই অমন দুচারটা গ্রামের লোক চিনে যায়। সেই রকম হবে হয়তো। তা যাক সে কথা। প্রথম বিশ্বফুটবলের সাথে টিভির পর্দায় পরিচয় হওয়ার পরই আমার ক্যানো সব ভারতীয়ের যে প্রশ্নটা আসে তা হল-- "ভারতের টিম নেই ক্যানো বাবা?"
তখনই বাবার মুখে শোনা সেই অলিম্পিকে ভারতীয়দের খালি পায়ে খেলে গোটা বিশ্বকে ধাঁ করে বোমকে দেওয়ার একটি রূদ্ধশ্বাস কাহিনীর বিবরণ। অনেককেই মিথ বুনতে শুনেছি যে ভারতের নাকি বুট কেনার পয়সা না থাকার কারণে ভারতীয় টিম খালি পায়ে খেলেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সেটা পুরোপুরিই যে স্রেফ গুল ছিল, সেটা বোঝার জন্য স্পেসসাইন্টিস্ট হতে হয় না। ফিফা বারবার উল্লেখ করেছেন- বেশির ভাগ ভারতীয় প্লেয়াররা খালি পায়ে খেলতেই স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাই তাঁদের কাছে বুট থাকলেও তাঁরা সেটা পরে খেলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। ফ্রান্সের সাথে খেলাটার আগে প্র্যাকটিস ম্যাচের দিন বৃষ্টির কারণে মাঠ ভেজা থাকায় সেই দিন প্রায় সকলেই বুট পরেই খেলেছিলেন। আর হ্যাঁ ভারতীয় অধিনায়ক শৈলেন মান্না ছিলেন না, ছিলেন--"তালিমারেন আও"।
২০শে এপ্রিল শিলং-এ শুরু হয় অলিম্পিকের দল বাছাই পর্ব। তাতে প্রথমিক পর্যায় চল্লিশজন খেলোয়াড়কে নির্বাচন করা হয় এবং অধিনায়ক হন তালিমারেন আও। এই আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য আনুমানিক লাখ খানেক টাকা ব্যবস্থাও হয়। বম্বে ও মাইসোর ফুটবল সংস্থা তুলে দ্যায় ২০ হাজার টাকা ও আই এফ এ প্রদান করে- ৪০ হাজার টাকা। বাকি টাকার ব্যবস্থা করতে এ. আই. এফ. এফ- কে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি।
বম্বে থেকে লণ্ডনের উদ্দেশ্যে ভারতীয় টিম জাহাজে যাত্রা করে।
ভারতীয় ফুটবল দল প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ১৯৪৮ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে। এই প্রতিযোগিতায় ভারতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা খালি পায়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে খেলতে নামে ইলফোর্ড অ্যামেচার ফুটবল ক্লাবের মাঠে। খেলার প্রথমার্ধে তিরিশ মিনিটে গোল করে এগিয়ে গেল ফ্রান্স। লেফট আউট কোরবিনের জোরালো শটে ভারতীয় গোলরক্ষক ভরদ্বাজ পরাস্ত হন। বিরতিতে ফল ফ্রান্সের পক্ষে ১-০। খেলা অবশ্য পরের অর্ধে বেশ জমে উঠে। ভারত পেনাল্টি আদায় করে নেয়। কিন্তু শৈলেন মান্নার পেনাল্টি শট বারের উপর উড়ে যায়। ফরাসীরা প্রথমে এগিয়ে গেলেও ভারতীয় ফুটবলার সরঙ্গপানি রমন ৭০ মিনিটে সমতা ফেরান। মহাবীর প্রসাদের থেকে বল পেয়ে আমেদ খান থ্রু দিলেন রামনকে। গোল করতে কোনও ভুলচুক করলেন না রামন। খেলা শেষ হতে তখন কয়েক মিনিট মাত্র বাকি হঠাৎই ভারতের পক্ষে এলো একটি পেনাল্টি। মহাবীর প্রসাদ গেলেন শট নিতে। কিন্তু তাঁর শটও ফ্রান্সের গোলরক্ষক আটকে দিলেন। সেই গোলই সেদিন তিনি আটকাননি আটকে দিয়েছিলেন আপামর ভারতীয়দের স্বপ্ন। গোল করে এগিয়ে যাওয়ার স্বর্ণ সুযোগ নষ্ট হল ভারতের। তবুও সমতায় ছিল সেটাও সদ্য স্বাধীন হওয়া একটা রাষ্ট্রের কাছে কম কিছু না ভেবে যখন নিজেদের স্বান্ত্বনা দিচ্ছিলাম আমরা একে অপরকে ঠিক তখনই ঘটল অঘটনটা। ফ্রান্সের পক্ষে জয়সূচক গোল করে বসলেন স্ট্রেপ। রেফারির লম্বা বাঁশি মাঠে উপস্থিত প্রায় দশ হাজার ভারতীয়র চকচক করে ওঠা রঙিন স্বপ্নেগুলি ছন্ শব্দে ভেঙে গ্যালো যা আজ অবধি আর জোড়া লাগল না। প্রথম রাউন্ডে বিদায় নিল ভারতীয় ফুটবল দল।
১ অগস্ট ১৯৪৮, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ফিফার বক্তব্য সমর্থন করে লেখে, ভারতীয় দলের একাংশই খালি পায়ে নেমেছিলl তাতে লেখা ছিল, "৮ জন ভারতীয় ফুটবলারের পায়ে জুতো ছিল না, কিন্তু তাতে তাদের বল মারতে কোনও সমস্যা হয়নি।"
অলিম্পিকের ওয়েবসাইটে তখনকার ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক তালিমেরেন আও বলেন—"দেখো, আমরা ভারতীয়রা ফুটবল খেলি, কিন্তু তোমরা খেলো বুটবল।"
যে সমস্ত ভারতীয় বীর ফুটবলাররা ছিলেন--
★তালিমারেন আও(অধিনায়ক)
★সাত্তার বশীর
★রবি দাস
★আহমেদ মহম্মদ খান
★শৈলেন্দ্রনাথ মান্না
★সাহু মেওয়ালাল
★তাজ মহম্মদ
★মহাবীর প্রসাদ
★বলরাম পরব রামচন্দ্র
★সরঙ্গপানি রমন
★কেঞ্চাপ্পা বরদারাজ
★ধনরাজ
★কাইজার
★অনিল নন্দী
★সন্তোষ নন্দী
★ভার্গেস
★সঞ্জীব উচিল
★বজ্রভেলু
তবে ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপের ইতিহাসটা সত্যিই রহস্যময়-- দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। ভারতের ফুটবল টিম যেহেতু খালি পায়ে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত সেখানেই বাধল যত কেলেঙ্কারি।
ভারতীয় ফুটবলাররা FIFA-কে জানালেন, তাঁরা খালি পায়েই খেলবেন বিশ্বকাপে। বুট পরতে পারবেন না। কিন্তু ফিফার নিয়ম হল, বুট ছাড়া ফুটবল খেলা যাবে না। অথ কিম্-
অনেকে ভারতের এই সিদ্ধান্তকে 'শতাব্দীর সেরা ভুল' বলে চিহ্নিত করেছেন। সে বছর বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল ব্রাজিল। বুট না পরার জন্য নাকি AIFF-এর ইচ্ছের অভাব ছিল, তা নিয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে। আসলে AIFF-এর কাছে তখন টাকাও ছিল না। ভারতীয় দলকে ব্রাজিল পাঠানোর ও তাঁদের তদারকির জন্য ফাণ্ডেরও অভাব ছিল। AIFF চেষ্টাও করেনি ফাণ্ডের বন্দোবস্ত করার। ভারত এদিকে বিশ্বকাপের দল ঘোষণাও করে দিয়েছে (১৬ মে ১৯৫০ সালে)। ১৫ জুন ব্রাজিল রওনা হওয়ার কথা ভারতীয় দলের। ২৮ জুন ছিল প্রথম ম্যাচ। তারপর? সে এক বিশাল রহস্য। বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের চেয়েও বেশি, যা আজও উদ্ঘাটন হয়নি।
আজ প্রতিটা ভারতীয়র হয়ে সেই স্বর্ণখচিত দিনগুলো ফেরৎ চাই আর একটিবার। এর বেশি কিছু নয়। আমরাও আমাদের টিমের হয়ে ভুভুজেলা বাজাবো কিম্বা শঙ্খ।