বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ সংগ্রহশালা : মেদিনীপুর

 বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ও সংগ্রহশালা : মেদিনীপুর



এমন এক প্রতিষ্ঠান, যার গল্পে সাহিত্য, গবেষণা, পরিশ্রম আর একটু ঘরোয়া উষ্ণতার মিশেল—যাকে বাদ দিলে বাঙালির বিদ্যাচর্চা যেন নিজের ভুলে যাওয়া শিকড়ের কাছেই আর ফিরে যেতে পারবে না। যদুনাথ সরকার ঋণস্বীকারের ভঙ্গিতে তাঁর শিষ্য-সহকর্মী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “আজ যে পরিষদের পুস্তাকাগার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির পরই সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষণা-সহায়ক কেন্দ্র হইয়াছে—শুধু বাঙ্গলা গ্রন্থ নহে, ইংরেজি ও অন্য কোও কোনও ভাষার উৎকৃষ্ট গ্রন্থে—তাহা ব্রজেন্দ্রনাথের গৃহিণীপনার ফল।” এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পন্ন হওয়ার কালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় বলেছিলেন—"বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাহিত্য পরিষদের শাখা থাকা খুবই প্রয়োজন। এই শাখাগুলো শুধু সাধারণ আলোচনা নয়, বরং স্থানীয় সমস্ত তথ্য, প্রাচীন পুঁথি, ঐতিহাসিক জিনিসপত্র সংগ্রহ করবে—এটাই সাহিত্য পরিষদের অন্যতম দায়িত্ব।"

      কবিগুরুর এই ভাবনা থেকেই মেদিনীপুর শহরের কিছু সাহিত্যপ্রেমী ও ইতিহাস-পসন্দ মানুষ একটি সাহিত্য সমাজ গড়ে তোলেন, যা পরে ব্যোমকেশ মুস্তাফীর উদ্যোগে ১৯১৫ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মেদিনীপুর শাখা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।


এর মূল উদ্দেশ্য ছিল—

সাহিত্যের উন্নতি,

দেশের ইতিহাস সংগ্রহ,

বিজ্ঞান, দর্শন আর প্রত্নতত্ত্ব চর্চা।

কিন্তু নিজের ভবন না থাকায় কাজকর্মে সমস্যা হচ্ছিল। তাই ১৩২৭ সালের ১৮ ফাল্গুন পরিষদের ষষ্ঠ অধিবেশনে মূল পরিষদের প্রতিনিধি নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত সবাইকে অনুরোধ করেন ভবন তৈরির জন্য সাহায্য করতে। নীহার পত্রিকা (২৪.৮.১৯২০) জানায়—তিনি নিজে চাঁদা দিয়ে সকলের কাছ থেকে অর্থ ভিক্ষা করেছেন। সেই সভাতেই কিছু টাকা সংগ্রহ হয়, আরও প্রায় ৫০০ টাকার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়।

কাঁথির খ্যাতনামা উকিল কার্তিকচন্দ্র মিত্রের পুত্র রমেশচন্দ্র মিত্র ভবন তৈরির জন্য দুই বিঘা জমি দানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ভবন নির্মাণে আনুমানিক ৮,০০০ টাকা লাগবে। বিদ্যাসাগরের মেদিনীপুরে যদি এই অল্প অর্থের জন্য সাহিত্য মন্দির তৈরি না হয়—এটাই তো দুঃখজনক! তাই দেশবাসীর কাছে আবেদন করা হয়—যার যা সামর্থ্য, দান করুন। কোষাধ্যক্ষ হিসেবে রমেশচন্দ্র মিত্র ও তাঁর সহযোগীদের ঠিকানা দেওয়া হয়।


কাঁথি প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা গঠনে ব্যর্থতা

মেদিনীপুরে যখন সংগ্রহশালা তৈরির উদ্যোগ জোরদার হচ্ছে, তখনই কাঁথিতে খেজুরীর ঐতিহাসিক মহেন্দ্রনাথ করণ ১৯২৩ সালে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা গঠনের চেষ্টা শুরু করেন। মহেন্দ্রনাথ করণ আজ প্রায় বিস্মৃত হলেও হিজলীর ইতিহাস রচনায় তাঁর অবদান অসাধারণ। স্যার যদুনাথ সরকার তাঁকে উচ্চ প্রশংসা করে লিখেছিলেন—মহেন্দ্রনাথ বস্তুনিষ্ঠ, নির্ভুল, জনপ্রিয় কল্পকাহিনিকে ছাড়তে ভয় পাননি।


তিনি শুধু ইতিহাস নয়, গৌণ্ড-ক্ষত্রিয় সমাজের উন্নতি ও আঞ্চলিক ইতিহাস উদ্ধারেও কাজ করেছেন। তাঁর উদ্যোগে কাঁথি ক্লাবে একটি প্রত্নগৃহ বা মিউজিয়াম স্থাপনের প্রস্তাব ওঠে। তিনি বলেন—হিজলী, বাহিরী অঞ্চলে খনন করলে প্রচুর পুরাবস্তু পাওয়া যাবে, কাঁথির ভগ্ন মন্দির-মসজিদ, পুষ্করিণী, স্থানীয় লোককথায় অনেক তথ্য লুকিয়ে আছে। কাঁথির সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য এমন সংগ্রহশালা তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য—মহেন্দ্রনাথের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কাঁথি ক্লাবও উদ্যোগ ধরে রাখতে পারেনি। তাঁর মৃত্যুর পরই সবই অঙ্কুরে শুকিয়ে যায়।


★মেদিনীপুরে সংগ্রহশালার প্রতিষ্ঠা★



অন্যদিকে, মেদিনীপুরে সংগ্রহশালার উদ্যোগ আকার পেতে থাকে। পাটনা বাজারে অস্থায়ীভাবে সাহিত্য পরিষদের শাখা তৈরি হয়। শুরু হয় প্রাচীন পুঁথি, মূর্তি, মুদ্রা, প্রত্নবস্তু সংগ্রহ।

      ঠিক তখনই নতুন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আসেন বিনয়রঞ্জন সেন (আই.সি.এস), যিনি আগেই মালদায় একটি মিউজিয়াম গড়ে তুলেছিলেন। তিনি এখানে এসে প্রথমেই বিদ্যাসাগরের বীরসিংহ গ্রামের বেদখল ভিটে উদ্ধার করেন এবং সেখানে সরকারিভাবে বিদ্যাসাগর স্মৃতিভবন তৈরি করান।

এরপর শহরেও বিদ্যাসাগরের স্মৃতিমন্দির তৈরির উদ্যোগ নেন। ১৯৩৮ সালে স্যার সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ ভবনের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভবনের উদ্বোধন করেন। যদুনাথ সরকার, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেনসহ অনেক বিদ্বান উপস্থিত ছিলেন।


উদ্বোধনে কবি বলেন—'বঙ্গসাহিত্যে আমার যদি কোনো কৃতিত্ব থাকে, তবে তার দ্বার উদঘাটনকারী বিদ্যাসাগর—তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পেরে আমি গর্বিত।'

       এ ভবনের একাংশেই পরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সংগ্রহশালা গড়ে ওঠে। এখানে সংরক্ষিত পুরাবস্তুগুলোর মধ্যে—

উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি

নটরাজ

ঋষভনাথের দুটি জৈন মূর্তি

চন্দ্রকোণা থেকে পাওয়া মনসা ও নৌকাবিলাস টেরাকোটা ফলক


১৯৫৫ সালে পাওয়া প্রাচীন মাটির প্রদীপ


নালন্দা থেকে পাওয়া পোড়ামাটির শিল


ফার্সী লিপিযুক্ত মসজিদ প্রতিষ্ঠাফলক


মুদ্রার সংগ্রহ (মনীষীনাথ বসুর দান)


বাংলা ২০১টি ও ৫০০-র বেশি সংস্কৃত পুঁথি


সবচেয়ে মূল্যবান সংগ্রহ—শশাঙ্কের আমলের দুটি তাম্রশাসন।

        ১৯৩৭ সালে মোহনপুর থানার আঁতলার সুরত খাঁ বন্দুক লাইসেন্স নিতে এসে ম্যাজিস্ট্রেটকে জানান তিনি দুটো "তামার কোদাল" পেয়েছেন। খুলে দেখতেই বোঝা যায়—কোদাল নয়, দুইটি তাম্রলিপি! রমেশচন্দ্র মজুমদার তা পাঠোদ্ধার করেন।


এভাবে তাম্রশাসন দুটি সংগ্রহশালার গৌরব হয়ে থাকে।


★গ্রন্থ প্রকাশ★

এই সময় পরিষদের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়—

বিনোদশঙ্কর দাসের জঙ্গল মহল ও মেদিনীপুরের গণবিক্ষোভ (১৯৬৮)

যা সংগঠনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।


ঋণঃ 

গেজেটিয়ার,তরুনদেব ভট্টাচার্য্য, হরিপদ মাইতি, তারাপদ সাঁতরা, যোগেশচন্দ্র বসু, নরেন্দ্রনাথ দাস প্রমুখ বিদগ্ধ জনের লেখা থেকে...


Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.