গমহাঃ একটি ব্যতিক্রমী দিন
গমহা একটি আদিবাসী ও গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক পরব, যা সাধারণত শ্রাবণ মাসের শেষ বা ভাদ্রের শুরুতে পূর্ণিমার দিনে পালিত হয়। এটি কোনও প্রচলিত হিন্দু বা সরকারি ক্যালেন্ডারে উল্লেখ না থাকলেও গ্রামের মানুষের জীবনে এর তাৎপর্য গভীর। কোথাও কোথাও একে গমহা পুইনহাও বলে। চাষের দুটো পর্যায় দুটি পুইনহার উল্লেখ আমরা পাই, প্রথমটা এই গমহার সময় আর দ্বিতীয়টি হাল-পুইনহা, আখ্যাইনের সময়। দুটোতেই গো উপাচারের প্রথা লক্ষণীয়।
গমহা শব্দের অর্থ নিয়েও মতভেদ আছে— তবে সময় ব্যতিরেকে অনেকের মনে হতেই পারে এটি কোনও অপশক্তির ইঙ্গিতবাহী উপাস্য। য্যামোন “ভর সাঁঝে ভাত খালে গমহা ধরে।” এই বাক্য বন্ধের থেকে মনে হতেই পারে গমহা কোনও অপশক্তি কিন্তু বাস্তবে তা এক্কেবারেই নয়, প্রত্যেক নেগ বা প্রথায় কিছু কিছু does & don'ts থাকে। এইক্ষেত্রেও তাই। (বিশেষ করে এই সময়কাল/ঋতুর এই বিশেষ দিনটিতে।) সন্ধ্যের সময় বিশেষ কিছু জীবানু/ ভাইরাস অ্যাক্টিভ হতে থাকে যা শরীরের পক্ষে স্বাস্থ্যকর তো নয়ই বরং ক্ষতিকারক তাই এই নিষেধাজ্ঞা। কুড়মিদের মধ্যে একটি দাঁতকথা খুব প্রচলিত-- "কব্বু নাঞ গমহা/ তার আরঅ পুন্নিমা।" অর্থাৎ যে কোনওদিন নিজেদের পরব (কুড়মিদের বাকি পরবের তুলনায় গমহার নেগাচার অনেক কম) গমহাই মানেনি সে আবার বৃহত্তর পর্যায় পুন্নিমা তিথি পালনের কথা বলে!! আক্ষরিক অর্থ এমনই। ব্যাখা বিভিন্ন হতেও পারে।
কেউ বলেন 'গো-মুহূর্ত' বা গো-সংক্রান্ত পবিত্র সময় কেউ বলেন 'গো-মুহূর্ত' বা গো-সংক্রান্ত পবিত্র সময়। তবে এই ব্যুৎপত্তি ও ব্যাখা দুটোই অত্যন্ত আধুনিক, অর্বাচীন। আরও স্পষ্ট করে বললে এই সবই সংস্কৃত্যায়ণের ফসল মাত্র। কুড়মিদের অধিকাংশ পরব-পারবণ তৎকালিন সময়ে এতটাই সময়োপযোগী ছিল যে প্রায় সমস্ত হিতমিতান গোষ্ঠীই তা আপন করে নিয়েছিল, কিন্তু পরব-পারবণটুকু গ্রহণ করলেও নেগ-নেগাচার পুরোপুরি আত্মস্থ না করায় এই বিভ্রান্তি। প্রত্যেক হিতমিতান গোষ্ঠী/জাতি তারা তাদের মতন করে প্রতিপালন করতে শুরু করে, যেমন ময়ূরভঞ্জ সীমান্ত এলাকার অধিকাংশ সম্প্রদায় (কুড়মি ব্যতিরেকে)এই গমহা পালন করে কিন্তু নিয়ম-রীতি তাদের নিজেদের, ব্রাহ্মণ ডেকে তাঁরা তাঁদের উপাচার করে থাকেন, যদিও তাঁদের ক্ষেত্রেও গো-অর্চনাই মূল ও একমাত্র, মাটি বিষয়ক তাঁদের কোনও রীতি থাকে না। তাই এই গমহা একান্তই কুড়মিদের, এতে কোনও সন্দেহ নেই।
চাষের কাজ শেষের দিকে এসে পড়লে শরীর যখন কাদামাটিতে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে আসে, তখন হয় গমহা—একদিনের ছুটি, বিশ্রামের দিন, আনন্দের দিন। এই দিনে গরুকে স্নান করিয়ে শিং-এ সিঁদুর-তেল দেওয়া হয়, হালের হাইল্যা বা লাঙলকে পূজা করা হয়। বাড়িতে বানানো হয় তালপিঠা—যদিও ভাদ্রে তাল খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত নয়, তবু গমহার দিনে "ছাড়"। (যদিও নিয়মটা অন্যরকম-- ঐ পিঠাটার নাম ধরলেই পিঠাটা খেতে হয়, মানে খেতেই হবে। তা সে যেই তিথি, দিনক্ষণ থাকুক না ক্যানো)
একটা সময় ছিল, যখন গ্রামবাংলার ধুলোমাখা আঙিনায় কৃষিজীবনের ছন্দ বাঁধা থাকত ঋতুচক্রের তালে তালে। তখন রহইন পরব ঘনিয়ে এলেই জানা যেত—ধান বোনার সময় ঘনিয়েছে। বোনা ধানের গাছি তখন আষাঢ়ের ভেজা মাটিতে চালা হতো, তারও এক আনন্দঘন নিয়ম ছিল। তখনো 'তলা ফেলে রুআ' করার চর্চা শুরু হয়নি—মাটির বুকের সঙ্গে কৃষকের সরাসরি সম্পর্ক ছিল গভীর ও আন্তরিক।
এই সময় ধান চালা হয়ে গেলে, শুরু হয় নিকান—য্যানো ধানের স্বপ্নকে আগাছার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য চাষিরা এক নিঃশব্দ যুদ্ধে নেমে পড়ে। এই ঘাস বাছাইয়ের কাজটা অবশ্য গমহা পূর্ণিমার আগেই শেষ করতে হয়, এমনটাই রীতি। কারণ, গমহা পরব মানেই ধান-চাষে একদিনের বিরতি, প্রশান্তি। একদিনের অবিচ্ছেদ্য আরাম।
কুড়মিদের লোক বিশ্বাস—গমহার দিনে ধানে হাত দিলে গমহা পোকা লাগে। তাই ঐদিন চাষের হাতিয়ার পড়ে থাকত কোঠায়, কৃষকের কাঁধে থাকত শুধু বিশ্রামের ভার। সেই দিনই চাষির ঘরে ডাক পড়ত সমস্ত কামিন-মুনিসদের। ধূপ-ধুনো, মাটির হাঁড়িতে রান্না করা মাংস আর ধোঁয়া ওঠা ভাত—এ ছিল এক ভোজের আমন্ত্রণ, একরকম সামাজিক বন্ধনের পরম্পরা। আজও সেই রীতি কুড়মিদের নেগ-নেগাচারের মধ্যে দিব্বিই বেঁচে আছে। গমহার দিনে যেহেতু ধানের জমিতে যাওয়া নিষেধ, তাই চাষিরা মন দিত বাড়ি-পিঁদাড়ের সব্জি-বাগানে। এই গমহার দিন হলুদ ও আলতি গাছের গোড়ায় মাটি দেওয়ার প্রচলন আছে। তাই বলা যেতে পারে এই গমহা পরব যতটা গরুর যত্নের বা উপাচারের ঠিক ততটাই মাটির প্রতি আস্থা জ্ঞাপনেরও। ও হ্যাঁ এই দিনই ফল সমৃদ্ধ কুমড়ো, লাউ বা ঝিঙের ঝাড় যেন অপদৃষ্টির(ফসল নষ্টকারী পোকা মাকড় বা বীজানুর) কবলে না পড়ে, তার জন্য খড়ে বা সুতোয় বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় খাঁখড়ি (কাঁকড়া) আর চিংড়ির দাঁড়া—যা আদতে একধরনের প্রতীকী নজরটোনা। য্যানো প্রকৃতিও বুঝে যায় যে—এই দিনটি শুধু কাজের নয়-- বিশ্বাস, পরম্পরা আর সংস্কারেরও।
গমহার একটি লোককহনিও প্রচলিত আছে। এই লোককথা অনুসারে, ---কোনও এক কালে এক ব্যক্তি তার বোনের বাড়ি থেকে ভাগ্না-ভাগ্নিকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে, কিন্তু সেই ব্যক্তির অবর্তমানে গমহার দিন ভাগ্না ভাগ্নিকে সমাদরের পরিবর্তে মামি দুজনকেই পাঠিয়ে দেয় জমিতে চাষের কাজের জন্য। তার পরিনাম হয় ভয়ঙ্কর, মামা তাদের খুঁজতে খুঁজতে বিলে(জমিতে) উপস্থিত হলে দেখে তারা সাপ হয়ে নালার জলে বয়ে চলে যাচ্ছে ক্রমশ দূর থেকে দূরে...। এই কহনি আসলে সমগ্র জীব/জড়সহ সকল প্রাণীকুলের প্রতি যাতে না অনাদর হয় তার ইঙ্গিতবাহী নির্দেশ। যা প্রতীকি।
তাই কুড়মিরা বিশ্বাস করে চাষের কাজ শেষের দিকে সমাগত হলে, শরীর যখন কাদামাটিতে ক্লান্ত হয়ে আসে, তখন আসে গমহা—একদিনের ছুটি, বিশ্রামের দিন, আনন্দের দিন। এই দিনে গরুকে স্নান করিয়ে শিং-এ সিঁদুর-তেল লাগিয়ে, হালের হাইল্যা ও লাঙলকে পূজা করার দিন। বছরের শেষ সেই পিঠাটা খাওয়ার দিন —যদিও ভাদ্রে এটি খাওয়ায় বিশেষ নিষেধ আছে তবু গমহার দিন ব্যতিক্রমী দিন।