আহাম্মকের গদ্য(৩৮)
গল্পটা আজও এমনি করেই লেখা হয়
গ্রামের ঠিক প্রান্তে, নদীর কোলঘেঁষে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এক প্রকাণ্ড মাঠ। মাঠটির ঠিক মাঝখানে নয় তবে রাস্তা থেকে খানিক ভেতরেই দাঁড়িয়ে থাকত প্রাচীন এই গাছটি—পাকুড়। ডালপালা মেলে ছায়া দিতে দিতে সে ভুলেই গেছল বোধহয় সে এদের কেউ নয়! সেই ছায়ার গভীরে জন্ম নিত কত শত নাম না জানা পাখির বাসা, কাঠবিড়ালির সংসার, আর কত না অদেখা প্রাণীর স্বর্গ। আমরা তখন খুব ছোট, ওর তলায় বসে খেলতাম বাঘবন্দির খেলা, বুড়োরা দুপুরবেলা গল্প করতে করতে স্মৃতি খেয়ায় ভেসে যেত কোনওদিন তাদের কৈশোরে যৌবনের উদ্দামতার দিনগুলিতে কিম্বা ছেলেবেলায়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাঁ ঘরের গোঠের গরু-ছাগল সেই ছায়ায় বিশ্রাম নিত কোনও নিরীহ গ্রীষ্মের দুপুরে। এই ভাবে কেটে যাচ্ছিল আমাদের নিস্তরঙ্গ অনাড়ম্বর দিনগুলি।
গাছটি যে শুধু প্রকৃতির অংশ ছিল তা নয়, বরং সে ছিল এক সমাজের নীরব রক্ষক, এক জীবন্ত ইতিহাস—যার ডালে বোনা ছিল স্মৃতি, যন্ত্রণার রক্ত, ভালোবাসা আর আত্মত্যাগ।
এমনই একদিন খবরটা দু চার কান হতে হতে ছড়িয়ে পড়ল —মাঠটা বিক্রি হয়ে গেছে। কিনে নিয়েছে জনৈক স্যামুয়েল ডি'সুজা বর্তমানে ঢ্যাপার বাপ। লোকটা বহু বছর আগে এসেছিল পশ্চিমের কোনও এক ভিনদেশ থেকে, কাগজে-কলমে নিজের জায়গা না থাকলেও রাজনীতির ছায়া আর প্রশাসনের ফাঁক গলে হয়ে উঠেছিল স্থানীয়। সে বলেছিল—"বাড়ি হবে এখানে, সমাজ সভ্যতা এগোবে। উন্নয়ন হবে।"
কিন্তু সভ্যতা মানেই কি লাশের ওপর ভিত! তখনও আমাদের মস্তিস্ক অত ভাবনায় পরিপক্ক হয়ে ওঠেনি অথবা সেই পরিসরও তারা কেউ দেয়নি আমাদের ভেতর। পাখির বাসা উড়িয়ে, কাঠবিড়ালির ঘর ভেঙে দেওয়ার মধ্যে যে পৈশাচিক উল্লাসে চারদিক ভোঁ ভোঁ করত তা কাকেই বা বলতাম?
অথচ চেয়েছিলাম গাছটি তার নিজের লড়াই নিজে লড়ুক, অথচ সেদিন, কিছু না বলে নতচোখে দাঁড়িয়ে ছিল গাছটি। তার পাতা আর কাঁপছিল না, শুধু বাতাস ভারী থেকে ভারীতর হয়ে উঠছিল ক্রমশ। কুঠারের আঘাতে একে একে গাছের শিকড় কাটা পড়ছিল, যেন কাটা পড়ছিল এক সভ্যতার শিকড়।
সাতুবুঢ়া বলত--"বাপ কাটা দেখবি তবু গাছকাটা কবু দেখবি নাঞ"
যদিও সে কথা আর রাখা হয়নি... দেখতে দেখতে আমরা ভাবছিলাম---
গাছটির জন্ম এই মাটিতে, এ মাটিরই ধুলোয় খসড়ায় গড়ে উঠেছিল তার দেহ। আদতে সেই তো ছিল আসল ভূমিপুত্র—এই গ্রাম, এই মাঠ, এই সমাজের আদি বাসিন্দা। অথচ সে একবারের জন্যও কিচ্ছুটি বলেনি, প্রতিরোধ তো দূর প্রতিবাদটুকুও করেনি। তার নিরবতা ছিল গহন, গভীর এবং মর্মস্পর্শী।
কিন্তু এই নীরবতাই কাল হলো তার।
তার সেই নিঃস্বার্থ দান, তার ছায়া, তার ফল—সবকিছু ভুলে গিয়ে মানুষ তার লাসের ওপর এঁকে দিল উন্নয়ন। আর গাছটি যে জমিতে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই জমির দলিল কার হাতে গিয়ে পড়েছে, কে জানে! শোনা যায়, কোনও সরকারী বাবু নাকি এক বিকেলে চুপিচুপি বিক্রি করে দেয় মাঠটা ঢ্যাপার বাপের কাছে। সে জানত গাছ কথা বলে না, সে জানত তার প্রতিবাদ নেই। কারণ সে ভূমিপুত্র। তার গড়ার ধৈর্য্য অপরিসীম। নিজের গোষ্ঠীর বাইরে কারুর সাথে তার সংস্রবে অনীহা।
তবে গ্রামের কিছু মানুষ মানতো—এই গাছ ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের সাক্ষ্য।
এই গাছের নিচেই একদিন তাদের দাদুরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সভা করেছিল, পলাতক বিপ্লবী আশ্রয় পেয়েছিল এই গাছেই।
তবুও, তারা কিচ্ছুটি বলেনি। হয়তো ভয়ে, হয়তো শংকায় অথবা লজ্জায়।
শেষ কুঠার পড়ার সময়, গাছটি একবার থরথর করে কেঁপে উঠেছিল। যেন তার প্রতিটি পাতায় লেগে ছিল এক একটি ইতিহাস।
তার ডাল থেকে ঝরে পড়েছিল এক বাসা—ছোট একটি কাঠবিড়ালির বাসা। ভেতরে তিনটি নিস্পাপ আলুথালু ছানা।
দুল্লি ছানাগুলোকে কোলে তুলে বলেছিল,
“অরহা কুথা যাবেক মাঞ? অদের ত আর গাছ নাঞখ!”
তার মা বলেছিল,
“এই ভূঞ এই মাটি যদি কথা বইলথ্যক, তাহইলে বইলথ্যক—হামার ছাতিয়েই ত ছিল অদের ঘর। উটাও তরহা ছাড়লিস নাঞ খালভরা”
এখানেই শেষ নয়। রোজ এমন কত গাছ কাটা পড়ে, রোজ এমনই কত ভূমিপুত্র উদ্বাস্তু হয়ে আবার নিজের নতুন করে গড়ে নেওয়ার আত্মবিশ্বাস নিয়ে নীরবে সরে যায় আরও কোনও এমনই উন্মুক্ত জঙ্গলের বুকে তার হিসেব কেউ রাখে না। এভাবেই সব ভূমিপুত্র নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে—নিজের শরীর নিজের অস্তিত্ব, ইতিহাস ও লড়াই বিকিয়ে দিতে দিতে।